আমরা সবাই জানি যে, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনকল্পে বাংলাদেশ সরকার ও JICA এর আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছে MRT-৬ প্রজেক্ট। MRT-৬ প্রজেক্টি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সর্বমোট ২০.১ কিলোমিটার পথ বিস্তৃত হবে। ১৬ টি স্টেশনের মধ্য দিয়ে প্রতি ঘন্টায় ৬০ হাজার লোক যাতায়াত করবে।
বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার লক্ষে টেকসই উন্নয়নের অংশ হিসেবে মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে অত্যন্ত শঙ্কার কথা যে, মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যস্থ বাংলা একাডেমি ও কার্জন হল এর মধ্যভাগে একটি স্টেশন নির্মাণ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে রুট নির্মাণ করলে শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তুলেছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করছি এবং শিক্ষা- শিক্ষাঙ্গন পরিবেশ, ভাস্কর্য ও জাতীয় ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যদিয়ে মেট্রোরেল রুটের বিরোধিতা করছি।
অধিকাংশের মত আমিও চাই মেট্রোরেল রুটটি শাহবাগ হয়ে মৎস্যভবন হয়ে যাক। মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবির স্বপক্ষে আমার যুক্তিগুলো-
প্রথমত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ৭১’র স্বাধিকার আন্দোলন, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য আন্দোলনের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জাতীয় ঐতিহ্য ও সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। টিএসসি সড়ক দ্বীপের ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যদিয়ে মেট্রোরেলের রুট নির্মাণ হলে রাজু ভাস্কর্যের একটি অংশ আজীবন মেট্রোরেলের রুটের ছায়ায় ঢেকে থাকবে।
সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীও তার আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন “সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য একটি ৩৬০ ডিগ্রী স্থাপনা। এর মাথার কাছে একদিক দিয়ে মেট্রোরেলের রুট হলে এর ত্রিমাত্রিক যে তাৎপ্রর্য, সেটা হারিয়ে যাবে। সিমেন্টের আস্তর ধ্বসে পড়বে, ভাস্কর্যে ফাটল ধরতে পারে”।
তাহলে কি এই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের প্রতীকগুলো উন্নয়নের ডামাডোলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
দ্বিতীয়ত: জাতীয় যাদুঘর, চারুকলা, তিন নেতার মাজার, ঢাকা গেইট জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা বা আইনানুযায়ী “কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা অথবা পুরাকীর্তির ২০০ বর্গমিটার এলাকায় কোন ভারী স্থাপনা তৈরি করা যাবেনা’’।
অর্থাৎ মেট্রোরেল বা অনুরূপ কোন স্থাপনা নির্মাণ জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। এর থেকে সৃষ্ট এক বছরের কম্পন একটি ৬-৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান। যা ঢাকা গেইট ও কার্জন হল এর জন্য হুমকিস্বরূপ।
তৃতীয়ত: মেট্রোরেল প্রজেক্ট তত্ত্বাবধান করার কাজ পেয়েছে NKDM association। এনকেডিএম মেট্রোরেল এর আর্কিওলজিকাল সার্ভের জন্য নিয়োগ দেয় AECL কে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপ্রক ড. এম এইচ হক- এর নেতৃত্বে এই সার্ভে হয়েছিলো।
গবেষণায় কাজ করেছিলেন মোট ১২ জন গবেষক। গত বছরের (২০১৫) মাঝামাঝিতে এই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছিলেন গবেষক দল।
প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে নেতৃত্বদানকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপ্রক মো. মোজাম্মেল হক বলেছেন, “শাহবাগ থেকে টিএসসি, কার্জন হল- এই এলাকাটা ইনস্টিটিউশনাল এরিয়া। এখানে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। এখান দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যেতে হলে সাউন্ড প্রুফ ও ভাইব্রেশন কন্ট্রোলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে রাজু ভাস্কর্যসহ যে সব স্থাপনা আছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি ভেঙে যেতে প্রারে।”
তারা উপসংহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই সার্ভেতে ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবী, স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন এবং তাঁরা প্ররামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল রেকর্ড,প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় টিএসসি-দোয়েল চত্বর দিয়ে রুট না নিয়ে শাহবাগ মৎস ভবন দিয়ে নেয়া হোক।উল্লিখিত রিপোর্টে সংসদ ভবনকেও বাঁচানোর সুপারিশ ছিলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রুট না নেবার কথাগুলো রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিলো। রিপোর্টে বলা হয়েছিলো— .. ..to trail towards Ramna and Matshya Bhaban area from Shahbag instead of conducting line towards TSC area to safeguard the area and it's adjacent archaeological, historical and national record.
চতুর্থত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যদিয়ে মেট্রোরেল নির্মিত হলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগসহ অনেক বিভাগের অবস্থান প্রস্তাবিত মেট্রোরেল রুটের সন্নিকটে।
এর শব্দ ও কম্পন (যে মাত্রায় হোক না কেন) শিক্ষার পরিবেশকে বিঘ্নিত করবে।এই মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকালে EIA রিপোর্ট অনুযায়ী তীব্র বায়ুদূষণ হবে। ৫-৬ বছরের জন্য ক্যাম্পাসে বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণের ফলে শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে।
যেখানে মেট্রোরেলের রুটটি সহজেই মৎস্য ভবন দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানে এতসব প্রতিকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে রুটটি নিতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র চরিত্র ও সাংস্কৃতিক বলয় ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত নয়তো!!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন- মেট্রোরেল প্রকল্প চূড়ান্ত করার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের(!!) সঙ্গে কথা বলেছেন।
এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে প্রধানমন্ত্রী কাকে বুঝিয়েছেন? যাদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয় সেই শিক্ষার্থীদের কোন মতামত গ্রহণ করা হয়নি।
দীর্ঘ ২৫ বছর ডাকসু নির্বাচন না দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হতে পারেনা। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং এক্ষেত্রেও পিছপা হবেনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব, ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বোপরি শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই মেট্রোরেলের রুটটি পরিবর্তন করে বিকল্প রুট ব্যবহার করার জন্য। অন্যথায় শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার আরেকটি অধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হবে।
No comments:
Write comments